আমাদের দেশের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন হচ্ছে ২১শে ফেব্রুয়ারি । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আমাদের দেশেরই বেশিরভাগ মানুষ তেমন একটা জানে না বা ভুল জানে । তাই আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার চেস্টা করবো ।
.
১) ২১শে ফেব্রুয়ারি কি? এটা কি স্বাধীনতা দিবস? বিজয় দিবস?
উত্তরঃ না, এটা আমাদের কাছে শহীদ দিবস এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ।
.
২) এই দিনটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই দিন কি যুদ্ধ হয়েছিল? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল?
উত্তরঃ না, এই দিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি, কোন যুদ্ধ হয়নি, বরং ভাষার দাবীতে মিছিল হয়েছিল । আমাদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে চলমান আন্দোলন এই সময়ে এসে চরম রূপ নিয়েছিল । আন্দোলনকে ঠেকানোর/দমানোর জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের এই দিন ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সেই কার্ফ্যু অগ্রাহ্য করে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে । পুলিশ সেই মিছিলের উপর গুলি চালালে সেই দিন হতাহত হয় রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার সহ আরও বেশ কিছু শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বরকত, রফিক, জব্বার সেই দিনই মারা যায় এবং সালাম প্রায় এক মাসেরও বেশি চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ এপ্রিল মারা যায় । কিন্তু সে দিনের ঘটনাতে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ার পরিবর্তে আরও তীব্রতা পায় এবং পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি আবার মিছিল বের হয় । পর দিনও পুলিশ গুলি চালায় এবং এই দিন মারা যায় শফিউর, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল ।
.
৩) ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর লাখো মা/বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে কি আমাদের এই ২১শে ফেব্রুয়ারি?
উত্তরঃ না, ভুল জায়গায় ঢিল ছুঁড়ছেন । উক্ত ব্যাপারগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত, ২১শে ফেব্রুয়ারি কিংবা ভাষা আন্দোলনের সাথে না ।
![]() |
![]() |
.
৪) নিহত সবাই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল?
উত্তরঃ না, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল । রফিক ছিল জগন্নাথের ছাত্র, সালাম একজন সরকারী কর্মচারী, শফিউর ঢাকা হাইকোর্টের কেরানী এবং জব্বার গ্রাম থেকে জরুরী কাজে ঢাকায় আসা একজন আম আদমী ।
.
৫) শহীদ মিনার কি? এটা কি কোন আমোদের জায়গা?
উত্তরঃ না, এটা কোন মজা বা আমোদের জায়গা না । “সেলিব্রেটিং একুশে-ফিলিং অসাম” বলে চেক ইন দেয়া বা সেলফি তোলার জায়গা না । এটার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাসের দুঃখজনক একটা অধ্যায় । এমন একটা অধ্যায় যেখানে নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল আমাদেরই কিছু ভাইকে । শহীদ মিনার তাদের স্মরণে এবং তাদের সম্মানার্থে বানানো একটি স্মৃতিস্তম্ভ ।
.
৬) শহীদ মিনার কারা বানিয়েছে?
উত্তরঃ শহীদ মিনার একবারেই তৈরি হয়ে যায়নি । ২১ এবং ২২ তারিখের ঘটনার পর ২৩ তারিখ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতেরাতেই একটা শহীদ মিনার দাঁড়া করিয়ে ফেলে । কিন্তু ২৬ তারিখ পুলিশ সেটা ভেঙ্গে দেয় । এরপর ১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমানের করা নকশা অনুযায়ী আবার শহীদ মিনারের নির্মান কাজ শুরু হয় এবং কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে । হামিদুর রহমানের সহকারী হিসাবে কাজ করেন বিখ্যাত ভাস্কর নভেরা আহমেদ, যিনি মাত্র দুই বছর আগে ২০১৫ সালে গত হয়েছেন । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আবারো ভেঙ্গে দেয় আমাদের শহীদ মিনারকে এবং সেখানে “মসজিদ” লিখে দেয় । স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে শহীদ মিনার আবার পুননির্মিত হয় ।
.
৭) শহীদ মিনারের বেদীতে জুতা পায়ে উঠা এবং দাপাদাপি করা কি নিষিদ্ধ? না হলে সবাই এটার সমালোচনা করে কেন?
উত্তরঃ শহীদ মিনারে জুতা পায়ে উঠাটা যতোটা না নিষিদ্ধ হওয়া না হওয়ার ব্যাপার, তার চেয়ে বেশি নীতি নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত একটা ব্যাপার । কেউ যখন অসুস্থ হয় বা মারা যায়, তখন কি আপনি তাদের সামনে বা তাদের কবর, শ্মশান বা এপিটাফের সামনে গিয়ে মজা মাস্তি করেন? মসজিদে, মন্দিরে কি আপনি জুতা পায়ে ঢুকেন? কেন দুই ক্ষেত্রেই আপনার উত্তর “না”? শুধুমাত্র মসজিদ, মন্দির বলে? না, তা না । বরং এই কারণে যে, এই জায়গাগুলাকে আপনি মন থেকে সম্মান করেন, পবিত্র ভাবেন । এই কারণে আপনার নৈতিকতাবোধই এই জায়গাগুলাকে অসম্মান করতে বাঁধা দেয়। শহীদ মিনারও একই । এটা কোন প্রার্থণালয় না । কিন্তু এটা আমাদের ভাষার জন্যই জীবন দেয়া কিছু মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে তৈরি স্মৃতিস্তম্ভ । এটা তৈরি করা হয়েছে এই কারণে যে, এখানে আসলে মানুষ যেন সেই শহীদদের আত্মদানটা মনে করতে পারে, নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে পারে । আপনি যদি ভাষার জন্য জীবন দেয়া মানুষগুলাকে, তাদের স্মরণে বানানো স্মৃতিস্তম্ভকে মন থেকে সম্মান করেন, তাহলে আপনার নৈতিকতাবোধই আপনাকে শহীদ মিনারে জুতা নিয়ে উঠতে, দাপাদাপি করতে বাঁধা দিবে ।
.
৮) ২১শে ফেব্রুয়ারি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে স্বীকৃতি কবে এবং কেন পেলো?
উত্তরঃ প্রথমে উত্তর দেই কেন পেলো তার । ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে একটি বেদনার দিন, একই সাথে গৌরবের দিনও বটে । গৌরবের কেন? কারণ, আমরাই সম্ভবত ইতিহাসের একমাত্র জাতি, যাদেরকে নিজের ভাষাতে কথা বলার অধিকারও আন্দোলন করে আদায় করে নিতে হয়েছিলো, প্রাণ দিতে হয়েছিল আমাদেরই কিছু মানুষকে । মাতৃভাষার জন্য এই আত্মত্যাগকে জাতিসংঘও শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করে নেয় ।
কানাডার ভ্যানকুভারে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষনা দেয়ার জন্য আবেদন জানান । সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয় ।

কি চমৎকার মিল, তাই না? আমাদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে দুইজন সালাম এবং রফিক । আবার আমাদের ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করেছে যে দুইজন, তাদের নামও সালাম ও রফিক । তাদের সম্পর্কে, তাদের উদ্যোগ এবং একুশে ফেব্রুয়ারীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠা সম্পর্কে আরও বিশদ জানা যাবে তাদের সাথে এই আলাপচারিতায়ঃ http://www.sachalayatan.com/rajibmostafiz/48215
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ভাষার জন্য জীবন দেয়া সেই ভাইগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা । ইশশ, তাদের মতো করে যদি নিজের দেশটাকে, নিজের ভাষাটাকে নিজের ভেতরে অনুভব করতে পারতাম !